প্রতিটা মিনিট'ই যেন ১০গুণ করে বেড়ে চলছে, সেই বিকেল ৪টা হতে বসে আছি, একজন কবি আসবে, যে জীবন্ত লাইব্রেরী নামে নাকি খ্যাত।
শুনেছি, তাঁর হার্ডডিস্ক নাকি এতটাই মজবুত যে, কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস এখনো জমা আছে। ব্যাক্তি, দেশ, বই ইত্যাদি রাজ্যের ইতিহাস সংস্কৃতি এবং সমসাময়িক বিষয়বস্তুর গঠনমূলক আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা হতে শুরু করে অর্থনীতি কিংবা শিক্ষা ব্যাবস্থার অবস্থা ও পরিণতি প্রায় বিষয়ই যেন তাঁর অবিদিত নহে। কয়েকটা টকশোতে শুনেছিলাম ওনার কয়েকটা বক্তব্য, তারপর আহমদ ছফাকে নিয়ে নাকি ব্রান্ডিং করা ইত্যাদি শুনতে শুনতে, 'আলাপচারিতা' নামের এক আড্ডায় আমিও যোগ দিতে এসেছিলাম।
হঠাৎ, অধীর আগ্রহে বসে থাকা শ্রোতাগণের করতালি দেখে নজর গেল মঞ্চের উপর, দীর্ঘ ৪০ মিনিট পর অপেক্ষার প্রহর শেষে খুবই সন্তপর্ণে মঞ্চে পদার্পণ করিল কবি।
খুবই উচ্ছসিত মনে তাকিয়ে আছি কবির দিকে, এতদিন ধরে এত ভালো বিশেষণ শুনে আসা মানুষটি আমার সামনে! হ্যা, আমি অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের কথাই বলতেছিলাম।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের 'আব্দুল খালেক মিলনায়তনে' আয়োজিত 'অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে আলাপচারিতা' অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল 'আহমদ ছফা'।
আহমদ ছফা স্যারের বেশ কয়েকটা বই পড়া হয়েছে আমার, এখনো পড়িতেছিলাম 'নিহত নক্ষত্র' প্রবন্ধগ্রন্থটি।
যাইহোক, খান সাহেব তাঁর দীর্ঘ ৪ ঘন্টা বক্তব্যের মধ্যে যা যা মনে আছে, কিছু কিছু নোট করে রাখছিলাম, সেটাই লেখার চেষ্টা করব, শুধুমাত্র, কয়েকবছর পর আজকের বক্তব্যটি কেমন লাগছিল সেই অনুভূতিটা বুঝার জন্য।
তাঁর বক্তব্যটা চট্টগ্রামের ইতিহাস দিয়েই শুরু হয়েছে। 'বারো আউলিয়ার শহর' চট্টগ্রামে কিভাবে মুসলিমের অভ্যুদয়, তারপর বিভিন্ন দেশ হতে এখানে ব্যবসায়ের নাম করে পর্তুগিজ,ইরান, ইংরেজরা আসা হতে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার কি কি ভুল ছিল ইত্যাদি।
এর পর বিভিন্ন দেশ হতে লোকের আগমনের ফলে বাঙ্গালির ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর কি প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে বিস্তর বক্তব্য। আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে কিভাবে মুসলিমের আগমন এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া, যেখানে বৌদ্ধ, তারপর হিন্দুদের সংখ্যা গরিষ্ঠতাই ছিল বেশি।
আহমদ ছফার বিভিন্ন বইয়ের মূলকাহিনী নিয়ে পর্যালোচনা এবং এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সমালোচকের কথার জবাব দেওয়া। আর, কোন প্রবন্ধ কোন প্রেক্ষিতে লিখে কি বুঝাইতে চাইছিল আর কোন দিকনির্দেশনাটাি দিতে চাইছিল, তা নিয়েও আলোচনা।
আহমদ ছফার আচরণ নিয়ে কয়েকটা উদাহরণ এই যে, সে আজীবন আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে ছিল, কিন্তু পচাঁত্তরের হত্যাকান্ড সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে নি।আহমদ ছফা কেন সরকারি কোন চাকরি করেন নি, একবার দেশ ভাগের আগে আহমদ ছফা কোন একটা কারণে ঢাকাকে উপমহাদেশের রাজধানী হিসেবে দাবী করা, বাংলা সাহিত্যের অতীতও বর্তমান অবস্থা, বিশেষকরে দেশভাগের পেছনে যে সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে তা তুলে ধরা ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সাল,জায়গা,ব্যাক্তি কিংবা বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর বক্তব্যের আরও কিছু লক্ষণীয় বিষয় ছিল কার্ল মার্ক্স এবং বাংলা ভাষা।
কার্ল মার্ক্সের শ্রমিক অধিকার ও মালিকের মূলধন বাজেটিং এর কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে বিশ্লেষণ করেন। তারপর আসে, বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখছে কারা,কাদের অবদান সবেচেয়ে বেশি কিংবা আজকাল যে, 'ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল' নামে ধনী লোকদের মাথায় যে রোগ প্রবেশ করেছে, এতে বাংলা ভাষাকে হীনতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে কিনা। পরিশেষে, তা হতে উত্তরণের উপায় নিয়েও কিছু আলোচনা করেন।
এরপর প্রশ্ন-উত্তর পর্বে বিভিন্ন সমস্যার কথা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
বক্তব্য চলাকালীন কিছু ছোট ছোট কথা নোট করে রাখছিলাম, হুবুহু তুলে দিচ্ছে।
* ভাষার ব্যাবহার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে⇨আমাদের চট্টগ্রামে যে সকল সেরা স্কুল আছে তাদের মধ্যে হয়তো গ্রামার স্কুল গুলোর অভিভাবকের ঝোঁক বেশি, কিন্তু এই নামটি যদি পরিবর্তন করে 'মক্তব' করা হয় তাহলে কেউ ওখানে ছেলেমেয়ে ভর্তি করাবে না।
* GDP নিয়ে⇨ দেশের হতদরিদ্র মানুষ যারা আছে তাদের আয় কতটুকু বেড়েছে সেটা নিয়েই কথা বলা উচিৎ। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন ১০ জন আয় বের করে নিয়েই GDP বের করা উচিৎ। না হলে একটা দেশের GDP সম্পূর্ণ ভুল হবে।
* আমরা যে গণতান্ত্রিকের ভবিষ্যৎ কি বলে প্রশ্ন করি, কিন্তু এটা করার আগে স্কুল প্রতিষ্টানের ভবিষ্যৎ কি? সেটা নিয়েই প্রশ্ন তুলা উচিৎ।
* দেশভাগের পেছনের কারণ হিসেবে ধর্ম রয়েছে। কেউ যদি এটা মানতে না চায়, তাহলে, তাঁকে আমার সাথে কথা বলতে বলি।
আমি চেষ্টা করেছি এখানে, সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যের মূল বিষয়গুলো কি ছিল সেটা তুলে ধরার জন্য।
এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে, এমন অনেকগুলো বক্তব্যও ছিল, যেগুলো আমার মনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরী করেছিল। কিন্তু সঠিক শব্দ চয়নের অভাবে সেদিকে নিয়ে এখানে লেখা হয় নি।
পরবর্তীতে যখন দীর্ঘ ৪ ঘন্টা বক্তব্যে শেষে যে যার মতো হল রুম ত্যাগ করতেছিল,
তখন খান সাহেবের সাথে একটা সেলফি তুলতে গেলাম, সব ঠিকঠাকই ছিল, যখনই ছবিতে ক্লিক করতে যাব, ঠিক তখনই, পেছন হতে এক ধাক্কা! ছবিটা ঝাপসা হয়ে গেল...🤮
1 Comments
ভালো মানের লিখা
ReplyDelete