লাইব্রেরী: পর্ব-০১

ব্রান্ডেড এক শো-রুমে গেলাম এক জুড়া জুতা কিনতে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ, পছন্দ হচ্ছেই না, কয়েক জোড়া পায়ে দিয়ে আয়নার সামনে হাঁটাহাঁটি করেও দেখলাম, কিন্তু না। আমার এমন জুতা ঘাটাঘাটি দেখে, এক সেলসম্যান, বাক্স হতে এক জোড়া জুতা নিয়ে, আমাকে দেখিয়ে বলল, এটি পায়ে দিয়ে দেখুন, বেশ মানাবে আপনাকে।
হাতে নিয়ে জুতা বিশেষজ্ঞের মতো এদিক-ওদিক উল্টে-পাল্টে দেখে পায়ে দিলাম। বেশ্ সব দিক দিয়ে ভালোই ছিল, তারপর স্টিকারে দাম দেখে চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা!
সবেমাত্র অফিস হতে সম্মানি গুলো হাতে পেয়ে, খুশি মনে বাড়িতে আসতেছিলাম। পায়ে যে চটি যুগল আছে, তা এতদিনে সম্ভবত পাঁচ মাস পার করবে, ঐ যে গত জৈষ্ঠ্যমাসে শুভ ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার জন্যই কিনেছিলাম, কয়েকবার জুতার ডাক্তার মুচি সাহেবদেরও দেখিয়েছি, গত পরশু যখন আবার গেলাম, চোখ উল্টো করে আমার দিকে তাকিয়ে ভিড় ভিড় করে কি যেন বলল, শুনার চেষ্টা করিনি, আবার গেলে নিশ্চয় কিছু উপদেশ শুনিয়েও দিতে পারে। অফিসের কলিগরাও প্রায় অস্বস্তিবোধ করে, চটিগুলোর দিকে তাকিয়ে। যাকগে এসব কথা, ফাবিহাও বলে দিয়েছে, এবারের সম্মানী গুলো হাতে ফেলেই যেন, এক জোড়া নতুন জুতা কিনি।
যাইহোক, স্টিকারের দাম দেখে, খুব স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে, সরল ভঙ্গিতে সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, ডিসকাউন্টের কোন অফার আছে কিনা।
তখন, সেলসম্যান ভদ্রতার সহিতে জবাব দিলেন,'দুঃখিত, এই মূহুর্তে আমাদের কোন ধরনের ডিসকাউন্ট অফার নেই,' তারপর সে নিজের দায়িত্ব মতো আমাকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলো, জুতা যুগল অনেক ভালো, অনেকদিন টেকসই হবে, সামনে এর দাম আরও বেড়ে যেতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি তারপর তাঁকে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্ট বললাম, যাতে এই সীমার মধ্যে কোন জুতা থাকলে দেখাতে পারে। তারপর, কতগুলো দেখিয়েছিল.. পছন্দ হচ্ছে না বলে, কোন মতে শো-রুমটি হতে বিদায় নিলাম।
সামনে আরেকটু হেঁটে, আরেকটা জুতার দোকানে প্রবেশ করলাম, দোকানটি যদিও কোন ব্রান্ডেড কোম্পানির না, তারপরও তারা দাবি করে, এদের জুতা গুলোই সবচেয়ে ভালো এবং কম দামে অনেকদিন টেকসই হওয়ার মতো সব ধরনের জুতা'ই পাওয়া যায়। এখানেও এক সেলসম্যান আমাকে খুব সম্মানের সহিতে জিজ্ঞেস করল,'স্যার, আপনার কোন ধরনের জুতা লাগবে?'
এদিক-ওদিক তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে এক জোড়া দেখিয়ে নিচে নামাতে বললাম। পায়ে দিয়ে দেখি ভালোই লাগছে, এতকিছু কম্পেয়ার করার মোডটা চলে গেছে, কোনভাবে নতুন একজোড়া পায়ে দিতে পারলেই হয়ছে।
এটি যেহেতু সাধারণ দোকান, সে অনুযায়ী, জুতায় কোন স্পেশাল স্টিকার দিয়ে দাম লেখা নাই। সেলসম্যানের কাছে দাম জিজ্ঞেস করতেই, আবার বড় একটা এমাউন্ট শুনে, রাগী চেহারা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'একদাম কত পারবেন?'
সেলসম্যান, 'এটা কোন ব্রান্ডের দোকান না যে, একদাম বলতে হবে, আপনি একটা বলেন, পারলে দিব, না পারলে চলে যাবেন।'
আমি খুব ভীতু মনে সেলসম্যানের দেওয়া দামের এক তৃতীয়াংশ বললে, সেও স্বাভাবিক ভাবে বলল,'আরেকটু বাড়াতে পারেন কিনা দেখেন', মধ্যবিত্তের টেকনিক অনুযায়ী, আমি দাম বাড়াতে পারব না বলে, অন্য দোকানে দিকে রওনা দেওয়ার চেষ্টা করতেই, বলল, 'টাকা দেন।'
আমি আমার পুরাতন চটিকানা প্যাকিং করে, নতুন জুতা গুলো পায়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছি, তখন শুধুই একটা চিন্তায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল,' বেটা আমাকে এত অল্প দামে দিয়ে দিলে কেন! ও তো একটু জোড়াজুড়ি করলে, আমি আরেকটু বাড়িয়ে দিতাম, না-কি আরও কম দামে চাইলেই দিয়ে দিত! আমার কাছ হতে কি তাহলে এতেও টাকা বেশি নিয়ে ফেলছে!'
ভাবতে ভাবতে বাসায় সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়তেই ফাবিহা দরজা খুলে দিল, যেন সে এতক্ষণ কড়া নাড়ার অপেক্ষায় দরজার ওপাশে বসে ছিল। আসার সময় দুটো কবিতার বই, আর কিছু বাজারও নিয়ে এসেছি।
হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে বসে, ফাবিহার সাথে আজকের কর্মকান্ডের প্রায় সবগুলোই বলা শেষ।
জুতার কথা উঠতেই বললাম, ব্রান্ডের জুতা জোড়া না কিনে ভালোই হয়ছে, অনেক টাকাই বেঁচে গেছে।

পরের দিন ছিল, বুধবার। সাধারণত এদিনে অফিস বন্ধ থাকে না। কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধিসহ, নানান সুবিধা বাড়ানোর জন্য গত কয়েকদিনের আন্দোলনের পর আজকে অফিস বন্ধ ছিল। সকাল পর্যন্ত বাসায় ছিলাম। বিকালের দিকে ফাবিহা অনেকদিন পর বায়না ধরল, কোথাও ঘুরতে বের হবে। শহরটা এখন পুরাতন মনে হয়। এক দশক পার হয়ে গেল, এই শহরে। ঘুরার কিংবা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য তেমন জায়গা নেই। এতদিন যা ছিল, তা-ও বড়সড় দালানে পরিণত হয়ে গেছে। সবকিছুই পুঁজিবাদীদের দখলে চলে গেছে। মেয়েদের সাজুগুজু করতে দেরী হয় এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু ফাবিহা তার উল্টো। আমার আগেই দেখি সে প্রস্তুত হয়ে গেছে। আজ সে, সাদা রঙের এক শাড়ি পড়েছে। সাদা রঙের শাড়িতে, ফাবিহাকে দেখতে এতো ভালো লাগবে তা জানা ছিল না। এই প্রথম সে সাদা শাড়ি পড়ল। জন্মদিন উপলক্ষে না-কি তার এক বান্ধবী উপহার হিসেবে দিয়েছিল। আমিও এক ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, দুজনে রাস্তা নেমে পড়লাম। ফুটপাত বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোন দিকে যাওয়া যায়, সেটার পরিকল্পনা করতেছিলাম। আকাশেও হালকা হালকা মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষাকাল হিসেবে তেমন ঝড়ো বৃষ্টি দেখা যায় না বললেই চলে। হঠাৎ মনে হল, এই সুন্দর পরিবেশে, এক গুচ্ছ কদম হাতে নিয়ে হাঁটলেই বেশ মানাবে। এমন সময় গুটি গুটি বৃষ্টি শুরু হল। তড়িঘড়ি করে, এক রিকশাই উঠে পড়লাম, রিকশা চলতে শুরু করল লাইব্রেরির দিকে। মাঝপথে একটু থামিয়ে এক গুচ্ছ কদম নিয়ে, তুলে দিলাম ফাবিহার হাতে। সে রিকশার হুডি নামিয়ে দিয়ে, গুনগুনিয়ে গান শুরু করল।
এর একটু পর রিকশা থেমে গেল, লাইব্রেরির সামনে। পাবলিক লাইব্রেরী, এখানেই আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল!!

(23.01.21)
Reactions

Post a Comment

0 Comments