২০২২ সাল শুরু না হওয়ার আগেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, 'এ বছরে শুধু বাংলাসাহিত্যের কালজয়ী বইগুলোই পড়ব'। কথায় আছে,'Don't judge a book by its cover'. কিন্তু আমি কভার দেখে বিবেচনা করে, ২০২১ সালের বইমেলা হতে বেশ কিছু নতুন লেখকের বই কিনে এনে নিজেকে প্রথমবার 'বই কিনে গরীব হয়েছি!' এমন মনে হয়েছিল।
যাইহোক, বছরের শুরুর দিকে বাংলাসাহিত্যের কালজয়ী বই গুলোর ছোট্ট একটা লিস্ট করে রাখি, যেগুলো ধীরে ধীরে কিনে পড়ব।স্টুডেন্ট হিসেবে হাতে তেমন এক্সট্রা টাকা-পয়সা না থাকাটাই অস্বাভাবিক কিছু না। হাতে এক্সট্রা টাকা/ টিউশন হতে টাকা ফেলেই চকবাজার কিংবা নিউমার্কেটের পুরাতন লাইব্রেরিতে গিয়ে লিস্ট হতে বেছে বেছে সাধ্যমত বই কিনে নিয়ে আসতাম।
পুরাতন লাইব্রেরিতে অতি-স্বল্প মূল্যে বেশ ভালো বই পাওয়া যায় বলে, আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি।
একদিন বাসায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে, একটা অনলাইন বুই শপে, চমৎকার একটা অফার(ডিসকাউন্ট) দেখতে পাই। এরপর রুমমেটকে দুষ্টুমি করে বললাম, বই গিফট্ দিবে কিনা।
ন্যানো-সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম, সে রাজি হয়ে গেল!
যাইহোক, ভালোবাসা রইল তার প্রতি। আমার পছন্দের লিস্ট হতে ১০টা বই গিফট্!!
তাছাড়া, 'বই বিনিময় উৎসব' নামে অতিসুন্দর একটা আইডিয়াও আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মাথায়! পড়া বই গুলোর বিনিময়ে, আর নতুন কতগুলো বই! বেশ অপেক্ষায় থাকতাম এ উৎসবের জন্য।
নতুন বছরের এই তীব্র শীতের রাতে, ভাবতেছিলাম, ২০২২ সাল আমাকে কি দিয়েছে...
তেমন কিছু খোঁজে পাইনি! বাস্তবিকভাবে বিবেচনা করলে, কেড়ে নেওয়া এবং পাওয়ার বিষয়টা প্রায় সমানই। তবে, নিজের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন অনুভব করতেছি, যেটা প্রকাশ করা যায় না। চিন্তাধারার পরিবর্তন, কিংবা কোন একটা বিষয়কে আগে যেভাবে বিশ্লেষণ/অনুধাবন করতাম তার অগ্রগতি।
যাইহোক এসবের ক্ষেত্রে সবকিছুর পাশাপাশি, ২২'র পড়া কিছু বইও অত্যন্ত সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে, মনে করি।
করোনার সময়কাল হতে, সারা বছরে কয়টা বই পড়ব, এরকম একটা Goal সেট করে,অনুসরণ করে আসিতেছিলাম। তখন বেশ ফ্রি সময়ও ছিল, জীবন নিয়ে এত মাথাব্যথা কিংবা কাজের চাপও ছিল না, তাই ভালোই বই পড়ার জন্য সময় পেতাম।
একইভাবে ২২শে বই পড়ার টার্গেট ছিল ৬৩টি, এবং দূর্ভাগ্যবশত অল্পের জন্য সেটাও ফিলকরা সম্ভব হয়ে উঠেনি। পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট, টিউশন সাথে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদির কারণে সময় বের করা কষ্ট হয়ে উঠেছিল।
২২শে'র পড়া ৫৬টি বইয়ের মধ্যে ১০টি বাছাই করলাম, যেগুলো আপনারাও পড়তে পারেন। আগেই যেহেতু বলছি, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী বইগুলোই ছিল প্রধান টার্গেট, সেহেতু অনেক ভাল বই ১০টার মধ্যে আনতে পারিনি। ক্যাটাগরি ভিত্তি করেই পছন্দ করছি। চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক তাহলে...
01: The things you can see only when you slow down
~ Haemin Sunim
☞ বইটি আমার পছন্দের লিস্টে টপে রাখতেছি, কারণ এটিই মনে হয় আমার চিন্তাধারা কিংবা বিশ্লেষণ ক্ষমতার মধ্যে একধরনের বিপ্লব গঠিয়ে দিয়েছে। খুবই সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম কিছু বিষয় যেগুলো আমরা দৈনন্দিন জীবনে মুখোমুখি/ব্যাবহার করে থাকি, সেগুলোকেই পুনরাবৃত্তি করে নতুন ভাবে ভাবতে শেখাতে বাধ্য করবে।
কাউকে যদি শুধু একটি বই সাজেস্ট করতে হয়, আমি এটাই করব। Must read it.
02: বিষাদ সিন্ধু
~ মীর মোশাররফ হোসেন
☞ দীর্ঘ সময় নিয়ে, খুবই উৎফুল্ল মনে পড়া বইটি। অনেকে 'ইসলামিক বই' ভেবে ভুলে করে থাকেন। লেখক নিজেই বলছে, এটি একটি 'ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস'।
এজিদের সাথে হযরত হাসান-হোসেন(রাঃ) দের মধ্যে যে মর্মান্তিক যুদ্ধ সংগঠিত হয়, তার আদ্যোপান্ত ইতিহাসটুকু নিয়ে, লেখক নিজের মতো করে শব্দ চয়ন এবং বাক্য-প্রকরণের মধ্য দিয়ে বইটিকে সাহিত্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। শব্দ চয়ন গুলো এমন ভাবে করা হয়েছে, কারবলার রক্তাক্ত প্রান্তেরর ইতিহাসটুকু আপনাকে ট্রমার মধ্যে ফেলে দিবে।
লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারতেছিনা, বইটি কি পরিমাণ এক থ্রিলিং অনুভূতি আমাকে দিয়েছিল,সেটা। জাস্ট রিড ইট।
03: মরণ বিলাস
~ আহমদ ছফা
☞ দেশের একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সময় গুনতেছে। পাশে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ নাই, শুধুমাত্র 'মাওলা বক্স' নামের একজন চাটুকার, প্রেসিডেন্টের কাছের মানুষ হওয়ার লোভে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মন্ত্রীর পাশে বসে বসে তোষামোদ করতেছেন।
মন্ত্রীর মনে হচ্ছিল, সে অল্পক্ষণ পরেই মারা, তার চোখের সামনে জীবনের সম্পূর্ণ অতীত ভেসে উঠতেছিল।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মাওলা বক্সকে তার কৃত কর্মকান্ড পর্যায়ক্রমে যখন উপস্থাপন করতেছিল, এবং বারবার নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছিল যে, নিজের কৃত অপকর্মের কোনটাতেই মন্ত্রীর প্রত্যক্ষ দোষ ছিল না।
একটা উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিবিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বইটি পড়ুন।
04: পুতুল নাচের ইতিকথা
~ মানিক বন্দ্যাোপাধ্যায়
☞ শশী, কুসুম, গোপাল, সেনদিদি, কুমুদ, মতি ইত্যাদি চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে আমাদের গ্রাম্যসমাজে প্রায় দেখতে পাই।
শহর হতে ডাক্তারি পাশ করে, গ্রামে এসে সাধারণ জীবনযাপন করতে গিয়ে, শশীর সাথে গ্রামের মানুষদের মধ্যে যে সখ্যতা গড়ে উঠে তা নিয়েই অসাধারণ একটা উপন্যাস।
গ্রামীণ সমাজকে উপলব্ধি করতে হলে, মানিক দা'র বিকল্প নেই বললেই চলে।
05: চাঁদের পাহাড়
~ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
☞ 'জঙ্গল সারভাইভাল মুভি'',অথচ আমি দেখি নাই, এরকম লিস্ট Imdb তে খোঁজে পাওয়া এক প্রকার দুষ্করই হবে।
'চাঁদের পাহাড়' উপন্যাসটিতে শঙ্কর নামের এক এডভেঞ্চার প্রেমী বাংলাদেশী, চাকরির সুবাদে সুদূর আফ্রিকাতে, জঙ্গলের পাশে এক ক্যাম্পে, রেলকর্মী হিসেবে যোগদান করে।
এতে নিয়মিত সিংহ, চিতাবাঘ, কিংবা বিভিন্ন সাপের ভয় নিয়ে শ্বাস রুদ্ধভাবে জীবন অতিবাহিত করতো।
এক পর্যায়ে আলভারেজ নামের এক পর্তুগিজের সাথে পরিচিতি হওয়ার পর, হিরার সন্ধান চাকরি ছেড়ে জঙ্গলে ঘুরতে থাকে। এতে প্রতিরাতেই বিষাক্ত সব জীবজন্তুর ভয় কাবু করত তাদেরকে, যদিও আলভারেজ ছিল দুঃসাহসিক।
চলার পথে বিভিন্ন বাঁধা যেমনঃ ঝড়-তুফান, আগ্নেয়গিরি, খাবার, পানীয়জল ইত্যাদি।
এসবের এক পর্যায়ে আলভারেজও এক গভীর অচেনা জনমানবহীন জঙ্গলে শঙ্করকে একা ফেলে ৩ আঙ্গুল ওয়ালা এক জন্তুর হাতে আহত বিদায় হন।
এরপর শঙ্কর কিভাবে তার বাকি জীবনটুকু এই অচেনা জঙ্গলে অতিবাহিত করে তা জানার জন্য অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।
06: Steal like an Artist
~ Austin Kelon
☞ Steal like an atist, যার বাংলা অর্থ দাঁড়াই, চুরি করুন একজন শিল্পী/সেলিব্রিটি/সফল ব্যাক্তি/ধনী ব্যাক্তি ইত্যাদিদের মতো করে।
লেখকের মূল বক্তব হলঃ পৃথিবীতে প্রায় 7.8 billion মানুষ রয়েছে, এখানে একজনের আইডিয়ার সাথে অন্যজনের আইডিয়ার মধ্যে মিল খোঁজে পাওয়া, কাকতালীয় কোন কিছুই নই।
মানবজাতি হিসেবে আমাদের অনেকেরই ভালো আইডিয়া আছে, হয়তো কাজে লাগাতে পারছি না।
অন্যদিকে যাদের আইডিয়া নাই, তারা অন্যের আইডিয়া চুরি করে কিংবা কিনে নিয়ে নিজেকে সফল হিসেবে গড়ে তুলেন।
বইটিতে মূলত কিভাবে আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে সফলতার চূড়ায় পৌঁছা যায়, তার এক দিকনির্দেশনা।
07: রাখাল
~ লতিফুল ইসলাম শিবলী
☞ 'রাখাল' উপন্যাসের মূল চরিত্রে ছিল 'পূর্বা দেবী' হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে এক প্রথা(ভুল ব্যাখ্যা) ছিল যার নাম 'সহমরণ কিংবা সতীদাহ'। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যু হলে, নরক হতে মুক্তি এবং স্বর্গ লাভ নিশ্চিত করার জন্য, চিতায় স্বামীর মৃতদেহ কোলে নিয়ে জীবিত স্ত্রী আগুনে দাহ হতো।
স্বামী রামদেবের মৃত্যুর পর আত্মীয় স্বজনরা, পূর্বা দেবীকে সতীদাহের জন্য বাধ্য করলে, সেখান হতে পালিয়ে গিয়ে এক মুসলিম রাখালের সাথে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বাঁচানোর জন্য লড়াই করে চলতে থাকে।
অন্যদিকে ৮-ই ডিসেম্বর ১৮২৯ সালে, রামমোহন রায়ের সাথে একাত্মতা গ্রহণ করে ইংরেজ সরকার উইলিয়াম বেন্টিংক সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আইন পাশ করেন।
পুরো হিন্দু সমাজ তখন দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, সতীদাহপ্রথা পক্ষে এবং বিপক্ষে।
08: জননী
~ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
☞ এক জননীর জীবনকাহিনী।
বিয়ের পর হতে শুরু করে সন্তানসন্ততির জন্ম, এবং তাদেরকে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে গিয়ে, এক জননীর পরিবার সামলাতে কতটুকু ত্যাগ এবং জীবনযুদ্ধের মধ্যে দৌড়াতে হয় তা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়।
স্বামীর অকাল পঙ্গুত্বের ফলে সুখী পরিবারের যে হাল হয়, তা ছেলে বড় হয়ে চাকরি করে আর্থিক কষ্ট হতে মুক্তিলাভের চিন্তাটুকু ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এককথায় অসাধারণ ছিল।
09: আমার বন্ধু রাশেদ
~ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
☞ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে স্কুল পড়ুয়া যাদের ঘুরি উড়ানো কিংবা লুকোচুরি খেলার বয়স, তাঁরা যে অসমান্য অবদান রেখেছে তা ফুটিয়ে তুলেছে।
জাফর ইকবালের সৃষ্ট উপন্যাসের মধ্যে শ্রেষ্ট সেরা কিশোর উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করা যায়।
10: সে ও নর্তকী
~ হুমায়ূন আহমেদ
☞ বছরের শেষ পড়া বই ছিল এটি। হুমায়ূনের লেখা মানে হল সাধারণত হাস্যরস মেশানো একটা গল্প।
আমরা যে যেখানে আছি সেটা নিয়ে সুখী না, সবসময়ই মনে হয় নদীর ওপারের মানুষগুলো বেশ সুখেই আছে।
স্বাতী এবং লিলি হল দু'টা সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র। স্বাতী ছিল প্রচুর স্বাধীন চেতা, এবং খামখেয়ালি মেয়ে, যখন যেটা মন চায় সেটা করতে পারত। অন্যদিকে লিলি ছিল অনেকটা ইন্ট্রুভার্ট টাইপের, এবং পরিবারের মধ্যেও অনেক বাঁধা-বিপত্তি পেড়িয়ে চলতে হয়।
'সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে'- উক্তিটি মনে হয় উপন্যাসটির জন্য বেশ কার্যকরই হবে। হাস্যরসের মধ্য দিয়ে পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর এবং অন্যান্য সদস্যদের ভূমকিা বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।
সময় নিয়ে পড়ে দেখুন একবার।
যাইহোক, লেখাটা ছোট করার চেষ্টা করেছিলাম, তাও অনেক দীর্ঘ হয়েই গেছে।
বই গুলো পড়ে দেখতে পারেন।
পৃথিবী বইয়ের হোক।
Happy reading 🌺.
0 Comments