আত্মকথা-০১

 কিশলয় স্কুলের হোস্টেল জীবন অর্থাৎ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর হতে হাতে প্রথম মোবাইল নিই ২০১৬ সালের মাঝখানের দিকে, বাটন মোবাইল।

এরপর উচ্চমাধ্যমিকের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম শহরে
হোস্টেল জীবনে মোবাইল নিষিদ্ধ ছিল বিধায়, আম্মুর সাথে দু'বার, সর্বোচ্চ তিন'বার কথা হতো। তখন যদিও আম্মু নিজ হতে স্যারকে কল দিলে। খুব বেশি মন কাঁদলে ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে গিয়ে বলতাম, 'আম্মুর সাথে কথা বলব'।
যেদিন প্রথম ২০১১ সালের দিকে বাড়ি হতে শিক্ষার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েছিলাম, তখন বছরের ৯০% এর বেশি সময় বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছি। ২০২০ এর করোনা কালীন ছুটি টাই ছিল, শিক্ষা জীবনে সবচেয়ে বেশি একনাগাড়ে বাড়িতে থাকা।
যাইহোক, বাটন মোবাইলটি (বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার এক সপ্তাহ পর হাতে এন্ড্রয়েডের ছোঁয়া) হাতে পাওয়ার পর হতে, আম্মুর সাথে কথা বলি নাই, এমন কোন একটা সিঙ্গেল দিন খোঁজে পাওয়া যাবে না। বাড়িতে থাকলে তো সরাসরি আর বাইরে থাকলে মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হতো।
এখন বিভিন্ন কাজে দিনের বেলায় কল দেওয়া হয়ে ওঠে না, আম্মুও বুঝে গিয়েছে, ছেলে দিনের বেলায় কিছুটা ব্যাস্ত থাকে। যাইহোক রাতের বেলা নিয়ম করে ঠিক ৯টা হতে ১০টার মধ্যে একবার কথা হয়। শুক্রবার অর্থাৎ ছুটির দিনে কল করলে বলে,'তুর তো আমাদের আর লাগেবে না!', দিনের বেলায় কল না দিলে।
রাতে যদি কোন কোন দিন কল দিতে দেরী হয়ে যায়, নানাভাবে অভিমাণ করার চেষ্টা করে।
শহরে থাকা অবস্থায় আমি কখন বাড়িতে যাব, এ নিয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষায় থাকে।
আমিও সময় এবং সুযোগ ফেলে, এ যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি টুকু মেঠানোর আশায়, এক মহাসাগর পরিমাণ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাজারো স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। স্বভাবতই, স্কুল-হোস্টেলের জীবন হতে আজ পর্যন্ত বাড়িতে যাওয়ার আগের দিন রাতের বেলায়, কোনভাবেই শান্তির ঘুম দিতে পারিনি। নানান স্বপ্ন এসে ঘিরে ধরত আমায়, বাড়িতে গিয়ে এটা করব, ওঠা করব ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিক সব পরিকল্পনা নিয়ে, গাড়ি হতে ঈদগাঁও বাজার নেমে আম্মুকে কল দিয়ে কোন বাজার/কিছু আনতে হবে কিনা, এবং সাথে কিছু নাস্তা(বাড়িতে পৌছাঁর পর সবাই মিলে একসাথে খাওয়ার জন্য) নিয়ে সিএনজি অথবা অটোরিকশার সাথেই রওনা দিই।
ঠিক যতবারই বাড়িতে যেতাম ছোটবেলা হতে বাড়ির ছোট ভাই-বোনরা, আমি গাড়ি হতে যে জায়গায় নামব সে জায়গায় এসে অপেক্ষায় থাকত।
আহা! কয়েকটা প্রজন্ম পার হয়ে যাচ্ছে এভাবে।
সবাই হৈ-হুল্লোড় করে রাস্তা দিয়ে আসার সময় পরিচিতি সবার সাথে যথোপযুক্ত কুশল বিনিময় করা হয়, এভাবেই বাড়ির ঘাঁটার সামনে আসতেই দেখি একে একে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।
আত্নীয় স্বজন সবাই বরাবরের মতোই বলবে, এবার তো একটু বেশিই শুকিয়ে গেচিছ। খাওয়া-দাওয়া করছ নাই?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে, ওরাই জবাব দিয়ে দিবে,' পড়ার চাপ বেশি, বড় হলে শরীর ফিরে আসবে।'
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও এখন শেষের দিকে, আব্বু তো নিয়মিত মনে করিয়ে দেয় 'ফ্যামেলি নিয়ে ভাববার জন্য', সেই সুবাদে এখন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, শুকায় গেছি কেন?
তখন আমি জবাব দিই, 'ফ্যামিলির চিন্তায় চিন্তায় শুকায় গেছি!!'
দাদি সাধারণত রুম হতে তেমন বের হয় না, তাই যতক্ষণ না দেখি, দাদি বলে চিৎকার দিলে, দাদি ধীরে সুস্থে উঠে আসবে, এরপর কোলাকুলি করে পাশে বসেই সবার সাথে একটুখানি আড্ডা। আম্মু তাড়াহুড়ো করবে, খেতে যাওয়ার জন্য।
সে যাইহোক ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়ার এক পর্যায়ে আম্মু বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে দিবেন। এটা করবি না, ঐটা করবি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমিও চুপ করে, বাধ্য ছেলের মতো শুনি সবকিছু।
এরপর শুরু হয় ছোট ভাই-বোনদের সাথে আড্ডা, খেলাধুলা, চিৎকার, চেঁচামেচি ইত্যাদি।
এর পরের দিন হতে আম্মুর সাথে নিয়মিত ঝগড়া,  আর আমার বোন মুচকি হেসে হেসে সমাধানের দায়িত্ব পালন করে থাকে। রাতের বেলা সবার সাথে সিনেমা দেখা, ল্যাপটপ হতে পুরাতন ছবির অ্যালবাম খুলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেওয়া।
এমন ভাবে চলতে চলতে আচমকা মনে পড়ে যায়, আগামীকাল সকালে শহরে চলে যেতে হবে!
তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক বিষন্নতা আকঁড়ে ধরে। পরবর্তী দিন আসার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত একটা সেকেন্ডও যাতে অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ রেখে সময়টুকু হাসির মধ্য দিয়ে স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার চেষ্টা করি। তবুও মন যেন কেমন এক শূন্যতায় হাহাকার করে।
বাড়ি হতে শহরে চলে যাওয়ার আগের দিনটিই সবচেয়ে সুন্দর দিন হয়ে উঠে। অবুঝ মন, আরেকটা দিন বাড়িতে থেকে যাওয়ার আকুতি করতে থাকে।
হাজার বছরের ক্লান্তি যেন আমায় ঘিরে ধরেছে, এমন ভঙ্গিতে বিছানায় মাথা রাখার আগেই চোখ দু'টো বুজে যায়।
পরের দিন যদি আম্মুকে সাতটায় ঘুম হতে ডেকে দিতে বলি, তখন আম্মু ভোর ছয়টা হতেই গরমের মধ্যেও পাখা বন্ধ করে দিয়ে ডাকা শুরু করবে,' এই আট বেজে গেছে কখন যাবি? তাড়াতাড়ি উঠে পর। দেরী হয়ে যাবে।'
আম্মু আরেকটু, একটু পর, পাঁচ মিনিট ইত্যাদি বলতে গিয়ে, আম্মু ততক্ষণে হাতে ব্রাশ ধরিয়ে দেয়, তারপর টেনে তুলে ফেলবে!
ঘড়ি দেখলে, হয়তো তখনও কমপক্ষে সাতটা বাজতে বিশ মিনিট বাকি!

রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ব্রাশ করার পর, এক পর্যায়ে খাওয়া দাওয়া রেডি হওয়ার পর, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে পড়ি। প্রথমে দাদির কাছ হতে বিদায় নিয়ে নিই, তারপর বাকি সবাই আমার পিছু পিছু বাড়ির ঘাটাঁর সামনে এসে অশ্রুশিক্ত নয়নে 'ভালোভাবে পড়াশোনা কর' এ উপদেশটুকু দিয়েই বিদায় দিয়ে দেয়। এ নিয়মটিই চলে আসতেছে, পালাক্রমে।
যাইহোক, আজ ২১শে আগস্ট, টিউশন হতে আসার পর বিপ্লব উদ্যানে বসে বসে আম্মুর সাথে কথা বলতেছিলাম। এক পর্যায়ে মোর্শেদ ভাইয়ের কথা উঠলে, আমি বললাম, ভাইয়া তো ফ্রান্স চলে যাবে, আগামী ২৮তাং।
তখন আম্মু বলল, কি জন্য যাচ্ছে? '
~পড়াশুনার জন্য আর কি।
আম্মুঃ পড়াশোনা শেষ হয় নাই, এখনো?
~ ফ্রান্স হতে পড়তে পারলে, আরও অনেক ভালো না? বিদেশ হতে ডিগ্রি নেওয়া মানে..
আম্মুঃ এটা কি ঢাকার চেয়ে দূরে?
~ বিদেশ মানে তো ঢাকার চেয়ে দূরে হবে না? (কিভাবে যে বুঝায় আম্মুকে...!)
আম্মুঃ তো এতো পড়ালেখার দরকারটা কি? মোর্শেদের ভাই তো বিদেশ হতে একটাও পড়ে নাই।
~ তো, মোর্শেদ ভাই যাচ্ছে আরকি!
আম্মুঃ ফেরেন্স(ফ্রান্স) কি ইন্ডিয়াতে?
~ আম্মু, ইন্ডিয়াতে গাড়িতে করে যাওয়া আসা যায়। মোর্শেদ ভাই তো ৭০,০০০টাকা টিকেট খরচ দিয়ে বিমানে করে যাবে। সৌদি আরবে ২০/২৫ হাজার দিয়ে যাওয়া যায় মনে হয়, তাহলে আবার ভেবে দেখেন ফ্রান্স কত দূর হবে।
আম্মুঃ তো, মোর্শেদের মা-বাবা,ভাইয়েরা কিছু বলতেছে না?
~ বলবে কেন? তাঁরাই তো উৎসাহ দিচ্ছে পড়ার জন্য আরও।
আমিও ভাবতেছি আমিও চলে যাব।
আম্মুঃ তাঁদের টাকাপয়সার কোন সমস্যা নাই তাই যাচ্ছে আর, তুই গিয়ে কি করবি? আর এখানে কি পড়াশোনা নাই? তাছাড়া তুর আব্বুর কথাও তো চিন্তা করতে হবে। সে তো অপেক্ষায় আছে, তুর পড়াশোনা শেষ হলেই দেশে (সৌদিআরব হতে) চলে আসার জন্য।
~আমি তো চলে যাব, এখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, পরীক্ষার দেওয়ার জন্য, বাইরে চলে যাওয়ার, কানাডা না-হয় আমেরিকায়।
এরকম আরো কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পাল্টা যুদ্ধের এক পর্যায়ে, আম্মু আমার কাছে হেরে গিয়ে, 'তুর যা ইচ্ছে কর, আমাকে বলার দরকার নাই। তুর কাউকে চিন্তা করারও দরকার নাই', ইত্যাদি বলার পর পরই ফোন কেটে দিল।
আমি মনে মনে কিছুক্ষণ হাসার পর, আবার কল ডায়াল করার পর দেখি আম্মু ফোন কেটে দিচ্ছে। বেশ কয়েকবার কেটে দিয়ে রিসিভ করা মাত্রই জিজ্ঞেস করলাম, বোনের-দাদির কি অবস্থা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে কথার মোড় ঘুরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার পর ফোন কেটে দিলাম।

পুনশ্চঃ আমি সত্যি সত্যিই বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য IELTS এর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু এসব বিষয় মোর্শেদ ভাই জানার পর আমাকে মনে করিয়ে দিল যে, আমিই নাকি পরিবারের একজন ছেলে। তাই, আমার যাওয়াটা সম্পূর্ণই অনুচিত। অথচ, আমি এর আগে জানতামই না যে 'আমি একমাত্র ছেলে'। যাইহোক, এই মুহুর্তে বাইরে পড়তে যাওয়ার স্বপ্নটা স্থগিত রইল, পরে সুযোগ এবং সময় সবটুকুই যদি অনুকূল অবস্থায় পাওয়া যায় তখন, ইনশাল্লাহ। ঠিক, এই মুহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিজিপিএ নিয়ে ঠানাঠানি অবস্থায়,(........)নতুন যুদ্ধে জয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ছোট্ট প্রয়াস চলতেছে।।
Keep me in your prayers.




Reactions

Post a Comment

0 Comments